অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান দরকার
প্রকাশিত : ২১:২৬, ৫ মে ২০১৮
দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে অভ্যন্তরীণ নানাবিধ সমস্যা মোকাবেলায় নজর দিতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়ের বৃদ্ধি ও রাজস্ব আদায়ে ক্রমাগত ঘাটতি কমাতে হবে। বাড়াতে হবে নাগরিকের অর্থনৈতিক কর্মদক্ষতা ও ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ। লাগাম টানতে হবে দারিদ্র্য, আয় বৈষম্যে ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির। নজর দিতে হবে কর্মমুখী শিক্ষা বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণ কমানোর প্রতি। তবেই বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকি কাটাতে পারবে বলে মনে করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান `উন্নয়ন অন্বেষণ` ।
প্রতিষ্ঠানের মাসিক `বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পর্যালোচনা` ২০১৮’র প্রাক-বাজেট সংখ্যায় এমনি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সম্ভাব্য আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি সতর্ক করে যে, নানাবিধ অভ্যন্তরীণ সমস্যা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো মোকাবেলায় গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণায় দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়।
আর্থিক ভারসাম্য: সরকারি ব্যয়ের বৃদ্ধি ও রাজস্ব আদায়ে ক্রমাগত ঘাটতি বাজেট ভারসাম্যের উপর চাপ বৃদ্ধি করছে। সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ করে `উন্নয়ন অন্বেষণ` বলে যে অনুন্নয়ন ব্যয়, বিশেষতঃ সুদ পরিশোধে ব্যয় সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে সুদ পরিশোধে বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা, তা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৭ হাজার ৯২০ কোটি টাকা হয়েছে।
রাজস্ব আয়ের ঘাটতি পর্যবেক্ষণ করে `উন্নয়ন অন্বেষণ` দেখায় যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের লক্ষমাত্রা ছিল ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা, যেখানে অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মাত্র ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকার রাজস্ব আহরিত হয়, যা লক্ষমাত্রার ৫০ দশমিক ৯১ শতাংশ। উল্লেখ্য, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময় এই হার ৫৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ ছিল।
কৃষি ও শিল্প: প্রযুক্তিতে বৈচিত্রহীনতার কারণে শিল্পখাতে অপর্যাপ্ত উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি কৃষিখাতের অসন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক কর্মদক্ষতাকে ব্যাহত করতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষি ও শিল্প খাতের অসন্তোষজনক প্রবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি দেখায় যে, শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির হার ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ১১ দশমিক ০৯ শতাংশ থেকে কমে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। তদুপরি উক্তখাতে প্রযুক্তি আত্তীকরণের পরিস্থিতিও মানসম্পন্ন নয়। অন্যদিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ থেকে সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৪ হয়েছে।
বহিঃখাত: এদিকে রফতানী আয়ে মন্থর গতির পাশাপাশি উচ্চ আমদানী ব্যয় ও প্রবাসী আয়ের হ্রাসমান প্রবৃদ্ধি লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ প্রয়োগ করছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন পরিলক্ষিত হয়। রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ থেকে কমে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ দশমিক ৭২ শতাংশ হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরের অগাস্ট মাসে রপ্তানি আয় ৩ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল, যা মার্চ মাসে ৩ দশমিক ০৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে আসে। অন্যদিকে, প্রবাসী আয় পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ হ্রাস পায়।
চলতি হিসাবের ঘাটতি বিশ্লেষণ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি উল্লেখ করে যে, আমদানী ব্যয়ের ব্যপক বৃদ্ধির বিপরীতে রফতানী ও প্রবাসী আয়ের মন্থর গতির কারণে চলতি হিসাবের ঘাটতি বর্তমান অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারী সময়ে ৬ দশমিক ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, বাণিজ্য ঘাটতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারী সময়ের ৬ দশমিক ০৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৯২ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেড়ে বর্তমান অর্থবছরের একই সময়ে ১১ দশমিক ৭৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে।
স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন সম্প্রতি ব্যক্তিখাতে অধিক পরিমাণে বৈদেশিক বাণিজ্যক ঋণ হতে আবির্ভূত ঝুঁকির মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। উল্লেখ্য যে, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ব্যক্তিখাতে বৈদেশিক বাণিজ্যক ঋণের পরিমাণ প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১১০০ কোটি মার্কিন ডলার হয়েছে, যা অর্থনীতির জন্য আশংকার কারণ হিসেবে দেখা দিতে পারে।
মূলধন গঠন ও বিনিয়োগ: ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের স্থবিরতা লক্ষণীয়। অন্যদিকে সরকারী বিনিয়োগে অদক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প ব্যয় বাড়াচ্ছে। তদুপরি, অবৈধ উপায়ে ক্রমবর্ধমান অর্থপাচার অর্থনীতিতে মূলধন গঠন ব্যাহত করছে এবং ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান সঙ্কট সামগ্রিক আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে সম্মুখীন করছে।
এদিকে বেসরকারী বিনিয়োগ ২২ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। তদুপরি, ব্যাপক হারে অর্থপাচারের ফলে পর্যাপ্ত মূলধন গঠন সম্ভব হচ্ছে না, যা জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি ব্যাহত করছে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’র সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে।
দারিদ্রতা, বৈষম্য ও জীবনযাত্রার মান: দারির্দ্য নিরসনের ধীরগতি ও আয় বৈষম্যের বিস্তৃতির পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্থায়িত্বকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করতে পারে। উচ্চ যুব বেকারত্বের হার দেশে জনমিতিক লভ্যাংশের সুযোগ সীমিত করার মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মদক্ষতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
দারিদ্রতা নিরসনের হ্রাসমান গতি এবং ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্যের দিকে আলোকপাত করে `উন্নয়ন অন্বেষণ` উল্লেখ করে যে গড় বাৎসরিক দারির্দ্য নিরসনের হার ২০০৫-২০১০ সময়ের ১ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে কমে ২০১০-১৬ সময়ে ১ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে, আয় বৈষম্য নির্দেশক জিনি সহগ ২০১০ সালের দশমিক ৪৫৮ থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে দশমিক ৪৮৩ হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ২০১৩ সালে বিশ্ব গড় জিনি সূচক ও দক্ষিণ এশিয়ার গড় জিনি সূচক যথাক্রমে দশমিক ৩৭১ ও দশমিক ৩৬২ ছিল।
সাম্প্রতিক সময়ের উচ্চ মূল্যস্ফীতির ক্রমবর্ধমান হারের কথা উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটি বলে যে মূল্যস্ফীতি জনগণের ভোগ ও সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমানোর মাধ্যমে তাদের জীবনমানের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। উল্লেখ্য যে বাৎসরিক গড় অনুযায়ী খাদ্য মূল্যস্ফীতি বর্তমান অর্থবছরের জুলাই ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ ছিল যা মার্চ মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ হয়।
মানবম্পদ গঠন: কর্মমুখী শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থার ঘাটতির পাশাপাশি সামাজিক খাতে অপর্যাপ্ত সরকারি ব্যয় অর্থনীতিতে মানব সম্পদ উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কার্যকারিতার অসন্তোষজনক পরিস্থিতি নির্দেশ করে প্রতিষ্ঠানটি বলে যে বেকার জনসংখ্যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ২৫ লক্ষ ৯০ হাজার থেকে বেড়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৬ লক্ষ ৮০ হাজার হয়েছে, যেখানে আরও ১৪ লক্ষ ৬ হাজার লোক আংশিক বেকার। উপরন্তু, শিক্ষা, কর্ম বা প্রশিক্ষণ কোথাও নিযুক্ত নেই এমন কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ৪ কোটি ৬৬ লক্ষ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ কোটি ৮২ লক্ষ হয়েছে, যা মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ৪৪ দশমিক ২৫ শতাংশ।
মানব সম্পদ উন্নয়নের হতাশাজনক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে প্রতিষ্ঠানটি বলে যে ২০১৭ সালের `বিশ্ব মানবস¤পদ সূচক` এ ১৩০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১১১তম। উল্লেখ্য, দেশের মোট বেকার জনগোষ্ঠীর ৩৯ শতাংশ শিক্ষিত বেকার যেখানে বিদেশী কর্মীরা প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১৬ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ আয় হিসেবে বৈধ পথে নিজ দেশে নিয়ে যায়। উপরন্তু, স্বাস্থ্যখাতে অপর্যাপ্ত সরকারী ব্যয় ব্যক্তির আউট-অব-পকেট ব্যয় বৃদ্ধি করছে। স্বাস্থ্যখাতে আউট-অব-পকেট ব্যয় ১৯৯৭ সালের ৫৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৫ সালে ৬৭ শতাংশ হয়েছে।
ব্যাংকিং খাত: ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক ভক্সগুরতার দিকে নির্দেশ করে `উন্নয়ন অন্বেষণ` বলে যে খেলাপী ঋণ ক্রমাগত বেড়ে চলছে যার ফলে ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সালের শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। এদিকে মূলধন ঘাটতি মেটাতে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোকে জনগণের করের টাকা থেকে ১৬ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা পুনঃমূলধনীকরণ করা হয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক দূর্বলতা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহকে আরও প্রবল করে তুলছে। উৎপাদনমুখী খাতগুলোতে প্রয়োজনীয় স¤পদ বন্টণ ব্যাহত হচ্ছে যা দেশের উৎপাদন সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি এর `বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পর্যালোচনা`র এপ্রিল সংখ্যায় মন্তব্য করে।
বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় `উন্নয়ন অন্বেষণ` কর্মসংস্থানের সুযোগবৃদ্ধিমুখী প্রবৃদ্ধি কৌশল গ্রহণ, কর ভিত্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে পর্যাপ্ত রাজস্ব আয় নিশ্চিতকরণ, আর্থিক খাতের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, ব্যাবসায়িক আস্থা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে বেসরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং কার্যকরী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের উপর গুরুত্বারোপ করে।
আরকে//টিকে
আরও পড়ুন